Thursday, March 12, 2015

কবিতা : ঐশী বাণী, ভ্রমণ, নাকি আইডিয়া?

কবিতা আর কিছু না, একটা প্রাচীন স্টেশন, বয়ে চলা ফিনফিনা হাওয়া, যেখানে কেউ গেলে বা না-গেলে তার কিচ্ছু যায় আসে না

কবিতা হীরার তলোয়ার, কাঠের পাঁজরা। মিছরি শব্দটাকে জরুরি মনে করি; দুধারি ছুরি তাই অপ্রিয় অথচ সেই নাছোড়বান্দা বন্ধু যাকে এড়ানো অসম্ভব। যা কিছু অন্যে দেখে না সেই নীলবর্ণ অসুখ দেখি, চোখে শিরিশ কাগজের ঘঁষা কার আর ভাল লাগে? আমাকে মারে যেই জন, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বড়সড় মানকচুর পাতা সেই বাড়িয়ে দেয় মাথার ওপর। তারপরেও বলতে হয় অসুখের কথা, এক ন্যাক্কারজনক গোছানো ভাষায়, প্রলাপও বিক্রি হয়। উহ, ভাল লাগে না, কিন্তু যাব কোথায়? এই হলো কবিতা। আমার শত্রুরাই কেবল আমাকে দিয়ে কবিতা লিখিযে নেয়। রাক্ষস-খোক্কস খেলি। যা মনে হয়, যাকে মনে চায় শায়েস্তা করি, রূপকথাকেও! রূপকথারা মরে না। কিন্তু হীরকরাজার সাথেই আজকাল রাজকুমারীর বড় দহরম-মহরম। অসহায় হতে হতে বাতাসে অসংখ্য বেলুন উড়িয়ে দিই, যদিও করাতকলে কাঠচেরাইয়ের শব্দে আজকাল বিমর্ষ বোধ করি না আমি। আহারে, মাঝখানে একটা রংরাং পাখির আবাস কমলো আর কি! আমি রংরাং পাখি চিনি না, কিন্তু তার কথা লিখি, ভাল লাগে না, তবু লিখি। আমি ম্যাচবাক্স-বাড়ি চিনি, তার ভেতরে কতো বারুদ তার গোপন হিসাব লিখে রাখি; লিখে রাখি খাপখোলা কলমে মনে মনে যাকে খুন করি তার পোট্রেট, সেই মারণাস্ত্রের হয়ে আমাকেই চাইতে হয় ক্ষমা। সামনে গীত, গীতা আর গ্যাড়াকল একাকার। ফুটপাত ধরে হাঁটি আর মফস্বল শহরের গার্লস স্কুল গড়িয়ে-গড়িয়ে আসে, পাশের ব্যালকনিটা লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে আমারই সামনে। পকেটে একটা নেইলকাটার নিয়ে ঘুরি, যখন-তখন নখ কাটি, তারপরেও বড় হয়ে যায় নখ, আঙুল কাটি; তারপরেও ঈর্ষা মরে না, ওদের নির্বাসন দেই কবিতায়।
কবিতা আর কিছু না, একটা প্রাচীন স্টেশন, বয়ে চলা ফিনফিনা হাওয়া, যেখানে কেউ গেলে বা না-গেলে তার কিচ্ছু যায় আসে না। তাহলে কেন লেখেন? এই প্রশ্ন শুনলে সুনীল গাঙ্গুলী বলতেন, ‘কিছু পারি না বলে লিখি’। আমার অবশ্য লেখালেখির নির্দিষ্ট কোনো কারণ নাই। বড়জোর নিজেকে ফুটবল প্লেয়ার মনে করতে পারি। ছোটবেলায় আমাকে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিশতে দেয়া হতো না। খুব খারাপ লাগতো। মনে হতো সব পানিতে গেলো বিকালে খেলতে না পারায়। কিন্তু আজ মনে হয়, খুব বেশি মিস হয়তো হয় না। কিছুতেই কিছু কমে না, বাড়ে না। সীমা কালবাসী বলে এক ইরানী কবি আছেন, যিনি এখন মার্কিন মুলুকে থাকেন, তার কয়টা লাইন মাথায় ঘোরে। সীমা বলছেন—‘কিছুই ঘটে না। আমি কেন্দ্রীয় উদ্যান ধরে হাঁটি/ সেখানে নেই কিছু, তারপরেই নো-ফ্লাইং জোন/ কেবল গলা গলিয়ে নেমে পড়ে না নিরর্থকতা/ গুলি চলে, রক্ত ঝরে; তবু এখানে ঘটে না কিছুই/ তবু লিখি,/ নিরর্থকতা যাতে আর নিরর্থকতার ভার বাড়াতে না পারে’। যেমনটা বললাম, খেলাটা জরুরী। বোদলেয়ারের রেশ ধরে বলি, মাতাল হও, কবিতা, নারী অথবা সুরা—যা তোমার ইচ্ছা। শুনছিলাম, জসিমউদ্দীনকে লোকে কবি বললে উনি দারূণ খুশি হতেন। আমি কি তেমন? মনে হয়, হ্যাঁ, মনে হয়, না; নিজেরে মনে হয় মনোবৈকল্যের রোগী ও যুগপৎ ডাক্তার। যদিও মৃত্যুর অধিক কোনো শুশ্রষা নাই। তারপরেও লিখি। মাঝে মাঝে মনে হয় কবিতা না লিখলেও চলে, কিন্তু কেনো লিখবো না? কবিতা আর কিছু না, একটা প্রাচীন স্টেশন, বয়ে চলা ফিনফিনা হাওয়া, যেখানে কেউ গেলে বা না-গেলে তার কিচ্ছু যায় আসে না।

The painting about a poem written by a famous sudanese poet , his name is Jamma. He suffered from schizophrenia and died in Kartoum North, Kober Assylum, but he wrote the most beautiful poetry.

কবিতা হলো খুব সচেতনভাবে অবচেতনের সাথে খেলা। ঐশীবাণী বলে কবির কিছু নাই

আমি ঐশীপ্রাপ্তিতে আস্থাশীল নই। কবিতা হলো খুব সচেতনভাবে অবচেতনের সাথে খেলা। ঐশীবাণী বলে কবির কিছু নাই। কবি বচন বর্ষণ করেন, যার স্রষ্টা ও প্রচারক তিনি নিজেই। কবি হওয়া একটা অবস্থা, ‘বিয়িং অর বিকামিং পয়েট’। কবিতা একজন স্নায়ুতীক্ষ্ণ মানুষের নিজস্ব রিয়েলিটির নিরিখে পলকা বোধের সমাবেশ। কবির কাজ ক্রিয়েটিভ রাশগুলোকে সিঙ্ক্রোনাইজ করা। স্বপ্নগ্রস্থ মস্তিস্ক একটা ক্রিয়েটিভ ইঞ্জিন। সেটা সবার আছে; আছে বলেই আমরা সবাই সম্পর্কিত। কখনো কখনো একজন কবি স্বপ্নগ্রস্থ মস্তিস্ক ও ঘটনাপ্রবাহের এডিটিং-এর কাজের মধ্যে ভেদরেখা ভুলে যান। হয়তো এটাকে ঐশীপ্রাপ্ত বলেন অনেকেই। একজন লেখক যখন ঘোরের মধ্যে থাকেন তখনই তিনি সজাগ। এটা একটা বস্তুগত ও সেমিকনসাস অবস্থা। ভাবনার প্রথম কিরণটি যখন উঁকি দিলো তখন যে সিনটাক্স, যে রূপকল্প, যে ক্ষোভ, যে লালসার বর্ণালী—তাকে ক্যাচ করাই হচ্ছে কবির মূল চ্যালেঞ্জ। কারণ একটু সময় পেলে পুরনো পাঠ ও পেছনমুখী অভিজ্ঞতা উদ্বায়ী চিন্তার দুয়ার বন্ধ করে দিতে পারে। তাই দেখা যায় একটি ভাবনা কবিতায় লিপিবদ্ধ হবার পর তাকে আর ঠিক আগের মতো মনে হয় না, অনেকক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠে অভিজ্ঞতাজাত দর্শন ও কবিতার পুনর্লিখন, এক সাজানো বাগান; মোঘল আমলের পর থেকে এরকম বাগান অনেক হয়েছে। চিন্তাটাকে ছেড়ে দিলে বরং তা হয়ে উঠতে পারে অরণ্যময়, প্রকৃতিক ও স্পন্দনশীল; ফলতঃ চেতনাপ্রবাহের কাছাকাছি। তাই জাগনা থাকাটা জরুরী, টেকনিকটাও। আর বলা বাহুল্য, স্নায়ুতীক্ষ্ণতা বা আন্দোলিত হওয়ার বিষয়টি এসব কিছুর পূর্বশর্ত।
কতো দগদগে এই সময় অথবা পোষা ইন্দ্রলোক। কিন্তু আমার কোনো দেবযান নেই, লিখতে পারি না কোনো রূপকথা, তবু লোকচুক্ষুর আড়ালে আজো পঙ্খিরাজ ঘোড়া পুষে যায় কেউ। ওরা কেশর ঝাঁকিয়ে সখ্য করে নেয় টাইম মেশিনের সাথে। মাঝেমাঝে এসবে বিহ্বল হয়ে যাই, পকেট থেকে নেইলকাটার বের করে দেখি, উধাও—তার জায়গায় পড়ে আছে চিরকুট। খালি চিরকুটে আঁকিবুকি করতে ক্রেয়ন খুঁজি, পরিরা রোজ রাতে ক্রেয়নের জন্য কান্নাকাটি করে। নূরের চোটে কয়লা হয়ে যাই, তাতে ৩ নম্বর লোকালগুলো থেমে থেমে অনেক দূর অবধি চলে যেতে পারে। এই যেমনি আজ টিকিট কেটে বসে আছি, দূর নক্ষত্রে চলে যায় রেণুভর্তি বসন্তের মালগাড়ি। কিন্তু আমি বর্ষামাশরুমের নীচে ব্যাঙাচিদের রহনসহন তদারকি করি। কবিতা তাই এক আশ্চর্য ভ্রমণ, যেখানে ক্ষুদ্র ধূলিকণাও স্বর্ণমহিমায় উত্তীর্ণ হতে পারে, রাত হয়ে যেতে পারে পরিদের ডাইনিং টেবিল, যেখানে এক দর্জি বালক নিজহাতে গড়ে দেবে প্রেয়সীর বিয়ের পোশাক। বিচ্ছেদ এতাই মধুর শব্দমালায়। সেই সেলাই মেশিনের ঘড়ঘড় কিংবা কবিতার ছন্দ সব এক সুতোয় গাঁথা। কবিতা কখনো ছন্দবর্জিত হতে পারে না, হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, চিন্তা ও বয়ানের একটা তরঙ্গ থাকে, তরঙ্গ মানেই তো ছন্দ; নাকি? বিষয়টা যদি হয় প্রথাগত স্বর, মাত্রা, অক্ষরবৃত্ত; তবে তা বয়ান কৌশলের পার্ট। চিন্তা বা অনুভূতির তরঙ্গই হলো আসল ছন্দ। এটা জরুরি নয় (হয়তো সম্ভবও নয়)—মস্তিষ্কে যে চিন্তাকম্পাঙ্ক, তা প্রথাগত ছন্দ মেনে সৃষ্টি হবে। জোর দিতে চাই, বয়ানে যাতে অনুভূতির কম্পাঙ্ক হুবহু ধরা পড়ে। সেক্ষেত্রে অই বিশেষ কবিতার সৃষ্টিলগ্ন, সেই সময়ে কবির জীবনাচার ও অন্যান্য মনোদৈহিক প্রভাবই নির্ধারণ করে কবিতা কীভাবে উপস্থাপিত হবে। এর ব্যত্যয় কবিতার স্বাভাবিকত্বকে খর্ব করে। তাই ছন্দ সহায়ক নাকি অসহায়ক, এই প্রশ্নই ওঠে না। বরং প্রশ্ন থাকতে পারে, আপনি চিন্তার অনুরণনকে ধরতে বা বয়ান করতে প্রথাগত ছন্দকে কতটুকু প্রাধান্য দেন। উত্তর হবে : ‘ইট ডিপেন্ডস্ …’।

না দর্শন, না নন্দনতত্ত্ব, না ধর্মপ্রচার, কবিতায় আইডিয়া জেনারেট করাটা জরুরি

কবিতাকে কীভাবে দেখি বা লিখি, এর রন্ধনপ্রক্রিয়া কেমন? এখানেই এসে যায় ফখরুদ্দিন বাবুর্চির সাথে মহল্লার বাবুর্চির কাচ্চিবিরানির পার্থক্য। শব্দ ভাষার ক্ষুদ্রতম একক। আমি ভাই মুক্তি দিতে চাই ফুল-পাখিদের, ওরা তো আর ফুল-পাখি নাই, প্লাস্টিক হয়ে গেছে, আর ওইসব সন্নিবেশে কবিতা হয়ে গেছে প্লাস্টিকের চটি, বড় বেশি ক্লিশে, বড় বেশি মনোটোনাস। আর মনোটোনাস ভাষায়, মুখে যা বলি তা কেন লিখি না? ভাষা তো আর এত পলিশ ফার্নিশ না। কত নিত্যনতুন ঝাক্কাশ শব্দ আসছে, এসে গেছে, বুলিতে-গুলিতে কতো কেরফা, কতো অবলীল-সাবলীল ফাউল-টক। আমি ফাউল টকের পক্ষে। তবে, তা ‘আনএডিটেড রাশ অব ক্রিয়েটিভ মাইন্ড’। কতটুকু পারি, সেখানেই আমার বিশেষত্ব, দুর্বলতা, আত্মপরিচয়। মনে হয়, ‘কেওয়াস বা মব পোয়েট্রি’ লিখি। যেটা এক ধরণের হুল্লোড়ি চেতন প্রবাহ। একটা আইডিয়া। কিছুটা এভিল মোটিভসহ সহজাত ম্যাডনেস। দেশে কবিতায় আইডিয়া জেনারেট করার ক্ষেত্রটিতে বড়ই আকাল। তাই না দর্শন, না নন্দনতত্ত্ব, না ধর্মপ্রচার, কবিতায় আইডিয়া জেনারেট করাটা জরুরি।

নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন, ”Colorless green ideas sleep furiously.” সত্যিই তো রঙহীন সবুজ বোধ ক্রুদ্ধভাবে ঘুমায়! কবিতা তো সেই আশ্চর্য মিরাকল, যার নাগাল সবাই পায় না। সেই নির্জন ও একাকীতম পথে শুধু নিমগ্ন একাকীত্ব। শোনা যায় “এক হাতে যে তালির জন্ম কেমনতর তার শব্দ?” যার চাবিকাঠি হয়তো থাকে মঙ্গলবারের বর্গাকৃতি শেকড়ে’।
কবিতার বড় শক্তি হলো কথা বা শব্দ। ভাস্কর চক্রবর্তী যেমন বলেছিলেন “কথার মধ্যে রহস্য আছে, তাকে কবিতা বলা যায়”—সেই রকম। ‘শয়নযান’ শিরোনামের যে মোটামুটি বড় প্রবন্ধে ভাস্কর এই কথা বলেছেন, সেই একই প্রবন্ধে ভাস্কর কবিতায় নতুনত্ব আনার ৫ দফা প্রস্তাবনাও দিয়েছিলেন। ১ম দফাতেই তিনি বলছেন কবিতার মতো কবিতা অথবা তথাকথিত কবিতাকে এই মুহূর্তে বাতিল করতে হবে। ২য় দফায় বলছেন : সমস্ত শাঁস থেকে কবিতাকে মুক্ত করতে হবে। স্বাধীন করতে হবে। প্রথাবাহিত কবিতা থেকে সরিয়ে নিতে হবে গয়না। ভাস্কর হয়তো কাটাকাটা সংলাপের কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বোধকে খণ্ডিত ঝলকানি বানানোর পাশাপাশি আর যা প্রয়োজন তা হলো দর্শন বা শ্লোগানকে আশ্রয় করে, প্রথাগত বাস্তবতাকে স্বীকার করে কবিতার যে উপস্থাপন কৌশল তা সেকেলে হয়ে গেছে। এখন তাই গহনা যেমন জরুরী তেমনি গহনা খোলাটাও।
এই বুদ্ধিবৃত্তিক ও ভিরিক্কিময় বোলচালে চলে আসে কবিতার ব্যাপারে অনাদিকাল থেকে চলে আসা জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগটিও। এপার বাংলায় উনিশ-আশি পরবর্তী কবিতায় এটা প্রবল। এখানে নতুনত্ব ও নিজস্বতা যতটা উচ্চকিত, যতটা উচ্চকিত কবির আমিত্ব, ততটা নিকটে নয় অ্যাভারেজ মানুষের চিন্তা কাঠামো। এটাও সত্যি, কবিতা সবার জন্য নয়, সবার জন্য নিউজপেপার। আবার কিছু ভিউজতো পাঠকদের অনুধাবনসীমায় রাখতে হয়। যেটা ধরে পাঠক আরো দুর্ধর্ষ আবিস্কারে আগ্রহী হবেন। এখন কবিতার পাঠক মনে হয় নিজেরাই—কবিরা; কিছু আছে ‘সাহিত্য করায়’ আগ্রহী নবিশ যশোপ্রার্থী। এর বাইরে কবিতার বই বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া কিশোর-যুবতীর সংখ্যা মনে হয় কমছে; কমেছে। কিন্তু কবিতা নিত্য। সময়ই ওর বুনন ঠিক করে দেয়। এমন ভাষা আর ঝলমলে শব্দের উলেল চাদর নিয়ে কেউ হয়তো আসবেন তার ভেতর দিয়ে ধ্বনিত হবে সংখ্যাধিক্যের কণ্ঠস্বর—জয় হোক কবিতার।

সবশেষে সেই পুরনো কথা : কবিতা আর কিছু নয়, একটা প্রাচীন স্টেশন, যেখানে কেউ গেলে বা না-গেলে তার কিছু যায় আসে না। মাইরি, কিচ্ছু যায় আসে না।

No comments: