—ওই শালা তোর মায়েরে ঠাপাই। বাঁইচ্যা গেলি।
বামদিকের ট্রাকের জানালার হাতল ধরে নিজেকে সামলে নেয় বসির।
—ওস্তাদ, পারলা না হালার সানডে-মানডে কোলোস কইরা দিবার?
প্রথম দিকে বেশ অবাক লাগতো বসিরের—‘এতো কিছু থাকতে ওস্তাদে কেন্ কুত্তার পিছে লাগে? পুলিশ থুইয়া, কুত্তা! পুলিশ রাস্তায় কতো কেরফা করে। কাগজপাতি ঠিক থাকলেও মাল চায়। সেই পুলিশ থুইয়া, রাস্তার ধার দিয়াও কুত্তা দেখলে পিইষ্যা দিবার চায় কেন্ ওস্তাদ’?
সেইবার ময়মনসিংগের ভালুকা মেলায় ওস্তাদের সাথে পরথম দেখা। ওস্তাদ তখন ফুল লোড। বাংলা মারছে কয়েক লিটার, অঘরের আখড়ায় মারছে দুই লোটা ভাং। এরপর হাতে শুকনার স্টিক। গন্ধে মশা-মাছি তফাত ভাগে। শরীফ-জমসেদের পাওনা টাকা দিতে না পারায় মেলার মেলা মাইষের সামনে উরাবিস্টি মাইর খাইতাছে বসির। ওস্তাদ তখন সিংঘের মুতন হাজির—“কোন খানকির পোলা রে, ওরে ঝাড়ছ কেলা? একলা বইলা? ওই, চুপ! ওর নটিরপুত, কয় লাখ টেকা পাইছ?”। বসিরের সাথে সাত জন্মেও পরিচয় নেই ফরিদের। বসিরের মনে হয় ফরিদ যেন ফেরেস্তা। কড়কড়ি আটটা পাঁচশো টাকার নোট বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বসিরকে বলে— ল, পঙ্খিরাজে উড়াল দেই। সেই শুরু। আজো পঙ্খিরাজেই ভাসছে বসির। আজ বুড়িমারি, কাল সাতকানিয়া, পশশু বেনাপোল—ওর নানীরে খালু, লাইফের পিনিক আর কারে কয়! পতেঙ্গা? না যামু না... বিচে মাল নাই... দিল কি তড়প-তড়প!
একদিন ভয়ে ভয়ে শুধায় বসির
—ওস্তাদ রাস্তায় কুত্তা দেখলেই খেইপ্যা যাও কেন? তোমারে কি কুত্তায় কাটছিলো?
—না। সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় ওস্তাদ।
বাংলার বতলটা ঠোটে লাগিয়ে বসিয় আবার জিজ্ঞেস করে
—তয়?
—তয় আবার কি?
বতলটা ওস্তাদের হাতে দিয়ে এবার নিজেকে ঠেস দিয়ে বসায় বসির।
—না, মানে ওস্তাদ। কামড়ায় নাই? তাইলে কি তুমি কুত্তারে কামড় দিবার চাইছিলা, হেই হালার পুত লেঞ্জা তুইল্যা ভাইগ্যা গেছিলো? বলেই জিভ কামড়ায়। পড়িমরি পা ধরে
—ওস্তাদ নেশার মালে বইলা ফেলাইছি, ওস্তাদ নেশার মালে... না-না। ওস্তাদ মালের নেশায়। না না...
ওস্তাদ কি মাই ডিয়ার! ডিপজলের লাহান হোহো কইরা হাসে।
—হা হা, ও হো হো, কুত্তারে কামড় দিবার চাইছিলাম! হো হো, কুত্তারে... মুখ দিয়ে পিচিক পিচিক করে বেরিয়ে আসে না গেলা বাংলা মদ।
—কি কস্, আরেকবার ক। ডরাইছ না। আরেকবার ক।
ভয়ে ভয়ে বসির বলে—তুমি কুত্তারে কামড় দিবার চাইছিলা, হেই হালার পুত লেঞ্জা তুইল্যা ভাইগ্যা গেছিলো?
ফরিদ হাসে হো হো হো-‘আরেকবার ক’।
গামছা দিয়ে লেজ বানিয়ে কিছুটা অভিনয় করে দেখায় বসির। ওস্তাদ আরো হাসে।
***
উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে খালি প্লটের ওপর বিরাট বালির আড়ত। এখানেই মকাম মালিকরা বালি আনে তুরাগ থেেেক, ভালুকা থেকে। ফরিদ বালি আনে ট্রাক ভরে। সেই বালিতে গড়ে ওঠে বড় বড় দালান। দশটার পর ট্রাকগুলো ঢাকায় ঢোকার অনুমতি পেলে বেড়ে যায় ট্রিপের তোড়জোড়। অবশ্য ভেতর দিয়ে কামারপাড়া হয়ে দিনের বেলাতেও বালি আনা যায়। তবে ওতে চেকপয়েন্টে গুনতে হয় বাড়তি কড়ি। খুব জরুরী ওডার না থাকলে সে পথে পা বাড়ায় না বালি ব্যবসায়ীরা। মধ্যরাতে শেষ ট্রিপটা আনার পর বিরাট অবসর পায় ট্রাক ড্রাইভাররা। এরপর খায়-দায়, গোল হয়ে ফুর্তি-ফার্তি করে। দারু-সারু চলে। টহল পুলিশরা দেখেও দেখে না।
বালির মকামের কয়েকশো গজ পশ্চিমে একটা ময়লার ডাস্টবিন। উত্তরার সবখান থেকে বাসাবাড়ির ময়লা এনে জড়ো করা হয় এখানে। তারপর ময়লার গাড়িতে করে নিয়ে ফেলা হয় মুগদাপাড়ার ভাগাড়ে। কোনো কোনো দিন পশ্চিম দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত হলে, ময়লার গন্ধে টেকা দায়। এরসাথে আছে ভাংড়ি-দোকনের দিড়িম দিড়িম শব্দ। তবু সব মিলিয়ে ভালই চলে যাচ্ছে বসিরের। কেবল দেশের বড় বড় নেতাদের হোগা মারা অবস্থা। হাসিনা কট, খালেদা জব-বন। এরশাদের জিবলা হান্দায়া পড়ছে ইন্দুরে গর্তে। রাতে ট্রকের বালির ওপর তিরপাল পেতে তার ওপরে ভাদ্র মাসের আকাশ দেখতে দেখতে বসির জিজ্ঞেস করে
—ওস্তাদ সব নেতাগো সোনা যে নেতায় যাইতেছে, কি ওইবো?
—কি আর ওইবো? এতো দিন দেশের হোগা মাইরা মজা লুটছে? এহোন দেহো শালারা, লাল দালানের মজা! সব হালারে ফাঁস দিয়া মারা উচিৎ। হালারা দেশের মাইনষেরে কুত্তা বানায়া ফেলাইছিলো।
—ওস্তাদ হেই বইলাই কি কুত্তা দেখলে চাপা দিবার চাও?
—আরে না, কুত্তার কোনো মা-বইন নাই।
ফরিদ ড্রাইভারের গোল্ডস্টার সিগারেটের ফিল্টারে আগুনের শেষ প্রজ্জ্বলনটা আরো তীব্রতর হয়। অনেকন কোনো কথা বলে না। ফরিদ এমনই। এই ঠাওর হয়, এই আর বাও মেলে না। এইতো সেদিন বালুর মাঠে যাত্রা দেখতে গিয়ে কি কান্ডটাই না করলো। খোদ ঢাকায় যাত্রার এমন রমরমা আয়োজন কেবল বালুর মাঠেই সম্ভব। তা যাই হোক। যাত্রায় সেদিন কালজলতার পালা। এরপর ফিলিমের গান। আরোপরে, রাত বাড়ার সাথে সাথে কেবল ঝাকানাকা। প্রিন্সেসদের হোগায় সে কি ঢেউ! পদ্মা, তুরাগ, নাফ-কপতা-বুড়িগঙ্গা! ওস্তাদ তখন ফুরফুরা মেজাজে। মুখে লালমিয়ার দোকানের মিষ্টি দেয়া ডবল-পান, হাতে বেনসন। ‘লুঙ্গিটারে ইকটু কায়দা কইরা ধইরা’— পিছনের ঘরটায় বসিরকে নিয়ে ঢুকে পড়ে ফরিদ। প্রিন্সেস শেফালী আঙুল মটকায় আর মুখে চুক্ষার মতো শব্দ করে।
—এতো দিনে মনে পড়লো? কয়দিন হইলে তো চইলেই গেছিলাম পেরায়।
ফরিদ তখন ভিন্ন জগতে। বলে
—ডাল্লিং, আমার ছুডো ভাই, স্বরো-স্বরা শিহে নাই। ইট্টু লেখাপড়া শিখাইয়া দিও।
গুরুর কথা শুনে মনে বিলাই ফাল দেয় বসিরের। একই সাথে শরমে মাথা চৌদ্দ হাত মাটিতে সেঁধায় আর কি। ওস্তাদ এমনি পাবলিক। কঠিন। এক কথায় ওস্তাদ একখান জিনিস; মাল; মেডিন চায়না বাংলাদেশে হয় না। তবু, আধো বুলিতে বসির বলে-
—ওস্তাদ। ও-স্তা-দ!
—কি রে, তুইও কি নেতা নাকি? আর্মির ডরে নেতায়া পড়ছোস।
—ওস্তাদ!
ফরিদ, বসির এমন কি প্রিন্সেস শেফালীও হাসে খিল খিল করে।
এমন প্রানখোলা ওস্তাদের মনে আছে এক চোরা দুঃখ। “ওস্তাদ, ভাবীর ফোন ধরো না কেন? কও ওহন না সামনে মাসে বাড়ি যাইবা; কইয়া দিলেই তো পারো।”-- বসির যতই বোঝায় ফরিদ ততই খিস্তি ঝাড়ে-
—ওই চোদানী মাগি ছুডো ভাইটার মাথা চিবাইয়া খাইতাছে।
একটুপরেই করে আক্ষেপ—“আপন ভাই আমার! মায়ের পেটের ভাই!”
পরনে বলে—কি করবো বেচারা বেডি, আমি বাড়ি থাহি না, হাজার হৌক যুয়ানকী বয়স।
বসির বিষ্ময় মানে
—কি কও ওস্তাদ, তোমার মাথার বল্টু খুইলা পড়ছে নাকি?
—নারে বল্টু খুলে নাই। টাইট দিতাছি।
মাঝে মাঝে বসির এক মনে ভাবে—তয় একখান কথা, ভাবীরে ওস্তাদ বহুদ মায়া করে। ছুডোবেলা বেনাপল থেইক্যা ভাগায়া আনছিলো তো। ভাবীর বাপেরা আছিলো-কঠিন টেরর, খবর পাইয়া পুলিশরে দিয়া রাস্তা বলক দিছে। তার ভিতরে দিয়াই টেরাক নিয়া পালাইয়া আইসে ওস্তাদ। মাওয়া ফেরিঘাট ধইরা, একটানে নরসিংদি পূবাইল-চর। লগেলগে কাজি ডাইক্যা নিকা। ধর তক্তা হান্দা পেরেক!
***
আগস্ট মাসের শেষ দিয়া তখন কাজ কাম তেমন নাই। ওই দিন, দিনভোর পুলিশ-আর্মির লগে পাবলিক কঠিন ফাইট দিতাছে। ভাইংগা একফাই কইরা ফালাইছে পোরাপাইনরা। এর ভিত্রে দুলারী ভাবী ফোন কইরা কাঁনলো খুব। ভারীর এক কথা—তুমি মাফ কইরা দেও আমারে! বসির দেখে ওস্তাদও চোখ মুছে জামায়। এরপরই ফরিদের বেরা চাপলো— নরসিংদি যাইবো। বসির যতোই বোঝায় দেশে কার্ফু, আর্মি দেখলেই গুলি করবো, ওস্তাদ বোঝে না। বলে,
—তুই বেশি বোঝেস? ভাঙ্গাভাঙ্গি আমরা করছি নাকি? আমাগোরে আটকাইবো কেন? আমরা কি নেতা নাকি? না ছাত্র? খালি টঙ্গী ব্রিজ পারোইলে কাম শ্যাষ...
শেষে ট্রাক নিয়ে ভিতর দিয়ে আব্দুল্লাহপুর ধরে টঙ্গি ব্রিজের কাছে এসে একটা চেকপয়েন্টে থেমে যায় ‘ঢাকা মেট্রো ক-‘বারো, পায়ত্রিশ, পাচ-পঞ্চাশ’। কোনো কথা শোনার আগে ওস্তাদ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ওই তো মাত্র কয়েক গজ দরে টঙ্গী ব্রিজ! ওইটা ঢাকার বাইর। ওইখানে কার্ফু নাই। বেয়নেটের গুতায় ছিলে যায় কনুইয়ের মাংস। ফরিদ মিনতি করে—স্যার আমার বৌ ওসুস্থ, যাইতে দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মারের পর নিলডাউন করে পুরো রাত কাটাতে হয় দুই ওস্তাদ সাগরেদকে। পরদিন বিকাল বেলা কার্ফু শিথিল হলে ছাড়া পায় তারা। মনে হয় কতো কাল কথা বলেনি, অথচ বলার কিছু নেই কারোর। মহাকালের নীরবতা ভাঙে বসিরের কথায়-
—তামারে বলছিলাম না ওস্তাদ, কার্ফু! কার্ফু। কইলাম, শুনলা না। কইলা এইডা অন্য সরকার। ওহন বুঝো ঠেলা!
—হ, কার্ফু, এতটুকু বলে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে স্কেলেটারে চাপ দেয় কনুইছিলা ফরিদ। টঙ্গী স্টেশন রোড পেরিয়ে চেরাগালী; বোর্ডবাজার পেরিয়ে নরসিংদি রোডের দিকে না গিয়ে ট্রাক মায়মানসিংয়ের দিকে যেতে থাকলে বসির হাহা করে ওঠে
—কি করো ওস্তাদ, নরসিংদির রাস্তা তো থুইয়া আইলা; ওই দিকে।
—জানি
—তাইলে?
—তাইলে; কি? নরসিংদি যামু না।
বসির আকাশ থেকে পড়ে। এত পেদানি খাওয়ার পর বস্ এগুলান্ কি বলে? ভাবীর লটরপটর কেচ্ছা শুনতে শুনতে, তার রুপের বর্ননা শুনতে শুনতে কেমন যেন তাকে দেখার লোভ ধরেছিল মনে। সেই আশার তবে বাঙ্গি-ফটাস! নিজেকে সংযত করে নিবিষ্ট ড্রাইভিং সিটের দিকে তাকিয়ে সাগরেদ বলে
—বস্, ভাবী তুমার লাইগা ওয়েট কইরা বইসা থাকবো।
— নারে, থাকবো না। কিছু বদলায় না কহনো।
বসির কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তখনই হেডলাইটের আলোয় একটা কালো কুকুরের মুখ ভেসে ওঠে রাস্তায়। মাত্র একশ’ গজের মতো দূরত্ব। ফরিদ দাঁত কিড়মিড় করতে করতে স্কেলেটারে আরো জোরে পা দাবায়
—শালা কুত্তার লেঞ্জা তেরাই থাকে। কুত্তার লাইফে ঘিনঘিন করে রে বছি...
খারা! অহনি পিইষ্যা দিতাছি।
বামদিকের ট্রাকের জানালার হাতল ধরে নিজেকে সামলে নেয় বসির।
—ওস্তাদ, পারলা না হালার সানডে-মানডে কোলোস কইরা দিবার?
প্রথম দিকে বেশ অবাক লাগতো বসিরের—‘এতো কিছু থাকতে ওস্তাদে কেন্ কুত্তার পিছে লাগে? পুলিশ থুইয়া, কুত্তা! পুলিশ রাস্তায় কতো কেরফা করে। কাগজপাতি ঠিক থাকলেও মাল চায়। সেই পুলিশ থুইয়া, রাস্তার ধার দিয়াও কুত্তা দেখলে পিইষ্যা দিবার চায় কেন্ ওস্তাদ’?
সেইবার ময়মনসিংগের ভালুকা মেলায় ওস্তাদের সাথে পরথম দেখা। ওস্তাদ তখন ফুল লোড। বাংলা মারছে কয়েক লিটার, অঘরের আখড়ায় মারছে দুই লোটা ভাং। এরপর হাতে শুকনার স্টিক। গন্ধে মশা-মাছি তফাত ভাগে। শরীফ-জমসেদের পাওনা টাকা দিতে না পারায় মেলার মেলা মাইষের সামনে উরাবিস্টি মাইর খাইতাছে বসির। ওস্তাদ তখন সিংঘের মুতন হাজির—“কোন খানকির পোলা রে, ওরে ঝাড়ছ কেলা? একলা বইলা? ওই, চুপ! ওর নটিরপুত, কয় লাখ টেকা পাইছ?”। বসিরের সাথে সাত জন্মেও পরিচয় নেই ফরিদের। বসিরের মনে হয় ফরিদ যেন ফেরেস্তা। কড়কড়ি আটটা পাঁচশো টাকার নোট বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বসিরকে বলে— ল, পঙ্খিরাজে উড়াল দেই। সেই শুরু। আজো পঙ্খিরাজেই ভাসছে বসির। আজ বুড়িমারি, কাল সাতকানিয়া, পশশু বেনাপোল—ওর নানীরে খালু, লাইফের পিনিক আর কারে কয়! পতেঙ্গা? না যামু না... বিচে মাল নাই... দিল কি তড়প-তড়প!
একদিন ভয়ে ভয়ে শুধায় বসির
—ওস্তাদ রাস্তায় কুত্তা দেখলেই খেইপ্যা যাও কেন? তোমারে কি কুত্তায় কাটছিলো?
—না। সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় ওস্তাদ।
বাংলার বতলটা ঠোটে লাগিয়ে বসিয় আবার জিজ্ঞেস করে
—তয়?
—তয় আবার কি?
বতলটা ওস্তাদের হাতে দিয়ে এবার নিজেকে ঠেস দিয়ে বসায় বসির।
—না, মানে ওস্তাদ। কামড়ায় নাই? তাইলে কি তুমি কুত্তারে কামড় দিবার চাইছিলা, হেই হালার পুত লেঞ্জা তুইল্যা ভাইগ্যা গেছিলো? বলেই জিভ কামড়ায়। পড়িমরি পা ধরে
—ওস্তাদ নেশার মালে বইলা ফেলাইছি, ওস্তাদ নেশার মালে... না-না। ওস্তাদ মালের নেশায়। না না...
ওস্তাদ কি মাই ডিয়ার! ডিপজলের লাহান হোহো কইরা হাসে।
—হা হা, ও হো হো, কুত্তারে কামড় দিবার চাইছিলাম! হো হো, কুত্তারে... মুখ দিয়ে পিচিক পিচিক করে বেরিয়ে আসে না গেলা বাংলা মদ।
—কি কস্, আরেকবার ক। ডরাইছ না। আরেকবার ক।
ভয়ে ভয়ে বসির বলে—তুমি কুত্তারে কামড় দিবার চাইছিলা, হেই হালার পুত লেঞ্জা তুইল্যা ভাইগ্যা গেছিলো?
ফরিদ হাসে হো হো হো-‘আরেকবার ক’।
গামছা দিয়ে লেজ বানিয়ে কিছুটা অভিনয় করে দেখায় বসির। ওস্তাদ আরো হাসে।
***
উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে খালি প্লটের ওপর বিরাট বালির আড়ত। এখানেই মকাম মালিকরা বালি আনে তুরাগ থেেেক, ভালুকা থেকে। ফরিদ বালি আনে ট্রাক ভরে। সেই বালিতে গড়ে ওঠে বড় বড় দালান। দশটার পর ট্রাকগুলো ঢাকায় ঢোকার অনুমতি পেলে বেড়ে যায় ট্রিপের তোড়জোড়। অবশ্য ভেতর দিয়ে কামারপাড়া হয়ে দিনের বেলাতেও বালি আনা যায়। তবে ওতে চেকপয়েন্টে গুনতে হয় বাড়তি কড়ি। খুব জরুরী ওডার না থাকলে সে পথে পা বাড়ায় না বালি ব্যবসায়ীরা। মধ্যরাতে শেষ ট্রিপটা আনার পর বিরাট অবসর পায় ট্রাক ড্রাইভাররা। এরপর খায়-দায়, গোল হয়ে ফুর্তি-ফার্তি করে। দারু-সারু চলে। টহল পুলিশরা দেখেও দেখে না।
বালির মকামের কয়েকশো গজ পশ্চিমে একটা ময়লার ডাস্টবিন। উত্তরার সবখান থেকে বাসাবাড়ির ময়লা এনে জড়ো করা হয় এখানে। তারপর ময়লার গাড়িতে করে নিয়ে ফেলা হয় মুগদাপাড়ার ভাগাড়ে। কোনো কোনো দিন পশ্চিম দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত হলে, ময়লার গন্ধে টেকা দায়। এরসাথে আছে ভাংড়ি-দোকনের দিড়িম দিড়িম শব্দ। তবু সব মিলিয়ে ভালই চলে যাচ্ছে বসিরের। কেবল দেশের বড় বড় নেতাদের হোগা মারা অবস্থা। হাসিনা কট, খালেদা জব-বন। এরশাদের জিবলা হান্দায়া পড়ছে ইন্দুরে গর্তে। রাতে ট্রকের বালির ওপর তিরপাল পেতে তার ওপরে ভাদ্র মাসের আকাশ দেখতে দেখতে বসির জিজ্ঞেস করে
—ওস্তাদ সব নেতাগো সোনা যে নেতায় যাইতেছে, কি ওইবো?
—কি আর ওইবো? এতো দিন দেশের হোগা মাইরা মজা লুটছে? এহোন দেহো শালারা, লাল দালানের মজা! সব হালারে ফাঁস দিয়া মারা উচিৎ। হালারা দেশের মাইনষেরে কুত্তা বানায়া ফেলাইছিলো।
—ওস্তাদ হেই বইলাই কি কুত্তা দেখলে চাপা দিবার চাও?
—আরে না, কুত্তার কোনো মা-বইন নাই।
ফরিদ ড্রাইভারের গোল্ডস্টার সিগারেটের ফিল্টারে আগুনের শেষ প্রজ্জ্বলনটা আরো তীব্রতর হয়। অনেকন কোনো কথা বলে না। ফরিদ এমনই। এই ঠাওর হয়, এই আর বাও মেলে না। এইতো সেদিন বালুর মাঠে যাত্রা দেখতে গিয়ে কি কান্ডটাই না করলো। খোদ ঢাকায় যাত্রার এমন রমরমা আয়োজন কেবল বালুর মাঠেই সম্ভব। তা যাই হোক। যাত্রায় সেদিন কালজলতার পালা। এরপর ফিলিমের গান। আরোপরে, রাত বাড়ার সাথে সাথে কেবল ঝাকানাকা। প্রিন্সেসদের হোগায় সে কি ঢেউ! পদ্মা, তুরাগ, নাফ-কপতা-বুড়িগঙ্গা! ওস্তাদ তখন ফুরফুরা মেজাজে। মুখে লালমিয়ার দোকানের মিষ্টি দেয়া ডবল-পান, হাতে বেনসন। ‘লুঙ্গিটারে ইকটু কায়দা কইরা ধইরা’— পিছনের ঘরটায় বসিরকে নিয়ে ঢুকে পড়ে ফরিদ। প্রিন্সেস শেফালী আঙুল মটকায় আর মুখে চুক্ষার মতো শব্দ করে।
—এতো দিনে মনে পড়লো? কয়দিন হইলে তো চইলেই গেছিলাম পেরায়।
ফরিদ তখন ভিন্ন জগতে। বলে
—ডাল্লিং, আমার ছুডো ভাই, স্বরো-স্বরা শিহে নাই। ইট্টু লেখাপড়া শিখাইয়া দিও।
গুরুর কথা শুনে মনে বিলাই ফাল দেয় বসিরের। একই সাথে শরমে মাথা চৌদ্দ হাত মাটিতে সেঁধায় আর কি। ওস্তাদ এমনি পাবলিক। কঠিন। এক কথায় ওস্তাদ একখান জিনিস; মাল; মেডিন চায়না বাংলাদেশে হয় না। তবু, আধো বুলিতে বসির বলে-
—ওস্তাদ। ও-স্তা-দ!
—কি রে, তুইও কি নেতা নাকি? আর্মির ডরে নেতায়া পড়ছোস।
—ওস্তাদ!
ফরিদ, বসির এমন কি প্রিন্সেস শেফালীও হাসে খিল খিল করে।
এমন প্রানখোলা ওস্তাদের মনে আছে এক চোরা দুঃখ। “ওস্তাদ, ভাবীর ফোন ধরো না কেন? কও ওহন না সামনে মাসে বাড়ি যাইবা; কইয়া দিলেই তো পারো।”-- বসির যতই বোঝায় ফরিদ ততই খিস্তি ঝাড়ে-
—ওই চোদানী মাগি ছুডো ভাইটার মাথা চিবাইয়া খাইতাছে।
একটুপরেই করে আক্ষেপ—“আপন ভাই আমার! মায়ের পেটের ভাই!”
পরনে বলে—কি করবো বেচারা বেডি, আমি বাড়ি থাহি না, হাজার হৌক যুয়ানকী বয়স।
বসির বিষ্ময় মানে
—কি কও ওস্তাদ, তোমার মাথার বল্টু খুইলা পড়ছে নাকি?
—নারে বল্টু খুলে নাই। টাইট দিতাছি।
মাঝে মাঝে বসির এক মনে ভাবে—তয় একখান কথা, ভাবীরে ওস্তাদ বহুদ মায়া করে। ছুডোবেলা বেনাপল থেইক্যা ভাগায়া আনছিলো তো। ভাবীর বাপেরা আছিলো-কঠিন টেরর, খবর পাইয়া পুলিশরে দিয়া রাস্তা বলক দিছে। তার ভিতরে দিয়াই টেরাক নিয়া পালাইয়া আইসে ওস্তাদ। মাওয়া ফেরিঘাট ধইরা, একটানে নরসিংদি পূবাইল-চর। লগেলগে কাজি ডাইক্যা নিকা। ধর তক্তা হান্দা পেরেক!
***
আগস্ট মাসের শেষ দিয়া তখন কাজ কাম তেমন নাই। ওই দিন, দিনভোর পুলিশ-আর্মির লগে পাবলিক কঠিন ফাইট দিতাছে। ভাইংগা একফাই কইরা ফালাইছে পোরাপাইনরা। এর ভিত্রে দুলারী ভাবী ফোন কইরা কাঁনলো খুব। ভারীর এক কথা—তুমি মাফ কইরা দেও আমারে! বসির দেখে ওস্তাদও চোখ মুছে জামায়। এরপরই ফরিদের বেরা চাপলো— নরসিংদি যাইবো। বসির যতোই বোঝায় দেশে কার্ফু, আর্মি দেখলেই গুলি করবো, ওস্তাদ বোঝে না। বলে,
—তুই বেশি বোঝেস? ভাঙ্গাভাঙ্গি আমরা করছি নাকি? আমাগোরে আটকাইবো কেন? আমরা কি নেতা নাকি? না ছাত্র? খালি টঙ্গী ব্রিজ পারোইলে কাম শ্যাষ...
শেষে ট্রাক নিয়ে ভিতর দিয়ে আব্দুল্লাহপুর ধরে টঙ্গি ব্রিজের কাছে এসে একটা চেকপয়েন্টে থেমে যায় ‘ঢাকা মেট্রো ক-‘বারো, পায়ত্রিশ, পাচ-পঞ্চাশ’। কোনো কথা শোনার আগে ওস্তাদ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ওই তো মাত্র কয়েক গজ দরে টঙ্গী ব্রিজ! ওইটা ঢাকার বাইর। ওইখানে কার্ফু নাই। বেয়নেটের গুতায় ছিলে যায় কনুইয়ের মাংস। ফরিদ মিনতি করে—স্যার আমার বৌ ওসুস্থ, যাইতে দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মারের পর নিলডাউন করে পুরো রাত কাটাতে হয় দুই ওস্তাদ সাগরেদকে। পরদিন বিকাল বেলা কার্ফু শিথিল হলে ছাড়া পায় তারা। মনে হয় কতো কাল কথা বলেনি, অথচ বলার কিছু নেই কারোর। মহাকালের নীরবতা ভাঙে বসিরের কথায়-
—তামারে বলছিলাম না ওস্তাদ, কার্ফু! কার্ফু। কইলাম, শুনলা না। কইলা এইডা অন্য সরকার। ওহন বুঝো ঠেলা!
—হ, কার্ফু, এতটুকু বলে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে স্কেলেটারে চাপ দেয় কনুইছিলা ফরিদ। টঙ্গী স্টেশন রোড পেরিয়ে চেরাগালী; বোর্ডবাজার পেরিয়ে নরসিংদি রোডের দিকে না গিয়ে ট্রাক মায়মানসিংয়ের দিকে যেতে থাকলে বসির হাহা করে ওঠে
—কি করো ওস্তাদ, নরসিংদির রাস্তা তো থুইয়া আইলা; ওই দিকে।
—জানি
—তাইলে?
—তাইলে; কি? নরসিংদি যামু না।
বসির আকাশ থেকে পড়ে। এত পেদানি খাওয়ার পর বস্ এগুলান্ কি বলে? ভাবীর লটরপটর কেচ্ছা শুনতে শুনতে, তার রুপের বর্ননা শুনতে শুনতে কেমন যেন তাকে দেখার লোভ ধরেছিল মনে। সেই আশার তবে বাঙ্গি-ফটাস! নিজেকে সংযত করে নিবিষ্ট ড্রাইভিং সিটের দিকে তাকিয়ে সাগরেদ বলে
—বস্, ভাবী তুমার লাইগা ওয়েট কইরা বইসা থাকবো।
— নারে, থাকবো না। কিছু বদলায় না কহনো।
বসির কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তখনই হেডলাইটের আলোয় একটা কালো কুকুরের মুখ ভেসে ওঠে রাস্তায়। মাত্র একশ’ গজের মতো দূরত্ব। ফরিদ দাঁত কিড়মিড় করতে করতে স্কেলেটারে আরো জোরে পা দাবায়
—শালা কুত্তার লেঞ্জা তেরাই থাকে। কুত্তার লাইফে ঘিনঘিন করে রে বছি...
খারা! অহনি পিইষ্যা দিতাছি।
1 comment:
chomotkaar laaglo . facebook-e ese dekhchhi vaaloi korechhi .
http://2000banglapoets.blogspot.com/2010/01/20th-post.html
natun post dekhun . montobyo raakhun .
Post a Comment